সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে স্থিতিশীল রয়েছে সুনামগঞ্জে। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে আসা ঢলে পঞ্চগড়ের করতোয়া, মহানন্দা, তালমাসহ প্রায় সব নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। নদীর পানি দুই কূল ছাপিয়ে গতকাল বুধবার জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা ও নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়েছে।
পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সহস্রাধিক পরিবার।
লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা এবং নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি আবার বিপত্সীমার ওপরে উঠেছে। এতে গতকাল লালমনিরহাটে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অন্তত দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তাবেষ্টিত নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে থাকে গতকাল দুপুর থেকে। ফলে লালমনিরহাট ও ডিমলায় সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে আবার বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার নিচে। তবে আগের দিনের চেয়ে নদীর পানি ১৬ সেন্টিমিটার (সেমি) বেড়েছে। কানাইঘাটে গতকাল সুরমার পানি ৪৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ৮৯ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে সিলেট নগরের উপশহর এলাকায় কমতে থাকা বন্যার পানি ফের বাড়ছে। নতুন করে পানি ঢুকেছে নগরের বিভিন্ন এলাকায়। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়ও দুই দিন ধরে পানি আবার বাড়তির দিকে। একই অবস্থা গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজারসহ বিভিন্ন উপজেলায়। পানি বিপত্সীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা সালেহ কবির বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারিনি। রাতে রাস্তা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এগুলো ট্রমার মতো হয়ে যাচ্ছে। ’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার টুকেরগাঁও গ্রামের ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, ‘আগের দিন থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত দেড় থেকে দুই ফুট পানি বেড়েছে। যদি আরো এক-দেড় ফুট পানি বাড়ে, তবে মানুষের বাড়িঘরে আবার পানি উঠবে। ’ জকিগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ গ্রামের ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আগের রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত আধাহাত পানি বেড়েছে। ’ তবে গোয়াইনঘাট উপজেলায় গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বানের পানি এক ফুটের মতো বাড়লেও বিকেলে তা আবার কমে যায়। অবশ্য বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, জকিগঞ্জের অমলসিদে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে গতকাল সন্ধ্যায় বিপত্সীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে বিয়ানীবাজারের শেওলায় এবং ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর পানি নতুন করে বাড়েনি।
পঞ্চগড়ে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। তবে রান্নার ব্যবস্থা না থাকায় বিপদে পড়েছে তারা। কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে পঞ্চগড় জেলায়। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে পঞ্চগড় জেলায়। এখন আস্তে আস্তে বৃষ্টিপাত কমবে।
উজানে ভারত থেকে আসা ঢলে পঞ্চগড়ের করতোয়াসহ বেশির ভাগ নদীতে মঙ্গলবার রাত থেকে অস্বাভাবিকভাবে পানি ও স্রোত বেড়ে যায়। বুধবার সকাল থেকে নদীর পানি বিপত্সীমার কাছাকাছি পৌঁছে। সেই সঙ্গে নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে জেলা শহরের কামাতপাড়া, ইসলামবাগ, রামেরডাঙ্গা, নিমনগর, খালপাড়া, কায়েতপাড়া, ডোকরোপাড়া, নতুন বস্তি খালপাড়া, তুলারডাঙ্গা, পৌর খালপাড়া, সদর উপজেলার হাড়িভাসা, রতনিবাড়ী, মাগুরা, ফুটকিবাড়ী এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত জেলা শহরের করতোয়া কালেক্টরেট আদর্শ শিক্ষা নিকেতনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
পঞ্চগড় পৌর এলাকার নিমনগরের সুমন আলী বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে এক মাসেও নদী ভরতে পারবে না। মূলত ভারত যখন বাঁধ খুলে দেয়, তখনই নদীতে পানি বাড়ে আর আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ি। ঘরবাড়ি ডোবার চিন্তায় মঙ্গলবার সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। আমাদের ঘরবাড়ির অর্ধেক ডুবে আছে। এখনো রান্না হয়নি। চরম কষ্টে আছি। ’
রামেরডাঙ্গা এলাকার বৃদ্ধা তনজিনা বেগম বলেন, ‘আমার কেউ নেই। নদীর পারে বাড়ি করে থাকি। আমার বাড়ি নদীর পানিতে ডুবে গেছে। আমি ছাগলগুলো নিয়ে কোনোমতে জানাজাঘরে আশ্রয় নিয়েছি। রাত থেকে এখন পর্যন্ত (দুপুর ২টা) পেটে খাবার পড়েনি। ছাগলকেও কিছু খাওয়াতে পারিনি। কেউ আমাদের খোঁজখবর নিতে আসেনি। ’
পঞ্চগড় পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, পঞ্চগড়ের বেশির ভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে। একযোগে এসব নদীতে পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। করতোয়া নদীর পানি বিপত্সীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। আমরা ধারণা করছি, শিগগিরই পানি আরো কমে যাবে। ’
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। পৌর এলাকার পানিবন্দি মানুষের জন্য ২০ টন চাল এবং বিভিন্ন ইউনিয়নে দুই টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তা পানিবন্দি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে। ’
নীলফামারীর ডালিয়া পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ৯টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপত্সীমার পাঁচ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুর ১২টায় বিপত্সীমার দুই সেন্টিমিটার এবং সন্ধ্যা ৬টায় পানি বেড়ে বিপত্সীমার সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। লালমনিরহাট পাউবো জানায়, গতকাল সকাল ৬টায় শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলার পানি বিপত্সীমার ১২ সেন্টিমিটার ও সন্ধ্যা ৬টায় বিপত্সীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে মঙ্গলবার বিকেল থেকে জেলায় টানা বৃষ্টি হচ্ছে। উজানে (ভারতে) ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নদী দুটির পানি বেড়েছে, যা অব্যাহত থাকবে। তিস্তা ও ধরলার নদীতীরবর্তীসহ নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ও ফকিরপাড়া এবং সদর উপজেলার কুলাঘাট, মোগলহাট ও বড়বাড়ি ইউনিয়নের অন্তত দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে মঙ্গলবার থেকে ধরলার পানি দ্রুত বেড়ে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিস্তা নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় ফের বন্যার হুমকিতে পড়েছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের চার হাজারের বেশি পরিবার।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, ‘গত ২০ জুনের বন্যা পরিস্থিতির পর খানিকটা বিরতি দিয়ে মঙ্গলবার থেকে ফের নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। বুধবার দুপুরে পূর্ব ছাতনাই ও ঝাড়সিংহেশ্বর গ্রামের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। গ্রাম দুটির দেড় হাজার পরিবার ফের বন্যার শঙ্কায় পড়েছে। ’
টেপাখড়িবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, তাঁর ইউনিয়নে এখনো বাড়িঘরে পানি না উঠলেও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ছেই।
ডালিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা বলেন, ‘দেশে ও উজানে ভারতে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করেছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। ’
সুনামগঞ্জে ভারি বর্ষণে সুরমা নদীর পানি গতকাল সকালে বেড়ে বিকেল থেকে কিছুটা কমতে থাকে। সন্ধ্যা ৬টায় সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ৭.৬৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়, যা বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচে। তবে ২৮ জুন এই সময়ে সুরমার পানি আরো বেশি ছিল। সুনামগঞ্জে প্রায় ১৯৬ মিলিমিটার ভারি বর্ষণের কারণে পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, গত দুই দিন রাতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় সুরমার পানি কিছু বাড়ে। আগামী ২৪ ঘণ্টা সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে। এদিকে বন্যাকবলিত ১১ উপজেলায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, সেনা, নৌ, কোস্ট গার্ডসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। [প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট এবং পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি। ]
কালের কণ্ঠ
মন্তব্যসমূহ