হিজবুল্লাহর ভয়াবহ রকেট হামলা, প্রতিরোধে ব্যর্থ ইসরাইল

লেবানন থেকে ফিলিস্তিনির হাইফা এবং গালিলি অঞ্চলের দিকে অন্তত ৩৫টি রকেট ছোঁড়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। সেনা সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ লেবানন থেকে এই রকেট হামলা চালানো হয়, এবং এসব রকেট হাইফা এবং পশ্চিম গালিলির দখলকৃত অঞ্চলে আঘাত হানে। জায়নিস্ট গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনো রকেট বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়নি। হাইফা শহরের বিভিন্ন এলাকায় রকেট হামলার সতর্কবার্তা শোনার খবর পাওয়া গেছে। আল-মায়াদিন টিভি চ্যানেল জানায়, হাইফার উত্তরে আল-কিরিওত এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। জায়নিস্ট গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দখলকৃত পশ্চিম গালিলির ইয়ারা শহরে এক ভবন হিজবুল্লাহর মিসাইল হামলায় পুড়ে যায়। অপরদিকে, আভিভিম, ইয়রাউনসহ ওপরের গালিলির বেশ কয়েকটি শহরে রকেট হামলার সতর্কবার্তা বাজানো হয়। সূত্র: মেহের নিউজ

তুরস্কে আবারও সামরিক অভ্যুত্থানের পদধ্বনি

 

২০১৬ সালে এরদোগান সরকারকে উৎখাতে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান চালানো হয়। ফাইল ছবি



এশিয়া এবং ইউরোপর সংযোগস্থলে অবস্থিত এ মুসলিম দেশটির গত একশো বছরের ইতিহাসে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে অনেকবার। দেশটির ক্ষমতায় আসা প্রায় সব জনপ্রিয় নেতাকেই সামরিক অভ্যুত্থানের হুমকি মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, কাউকে আবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।  


বর্তমান রাষ্ট্রপতি রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ানও তার উনিশ বছরের শাসনামলে অনেকবার সামরিক অভ্যুত্থানের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। কখনো মোকাবেলা করেছেন রাজনৈতিক চালে আবার কখনও বা আইনের মাধ্যমে। আর সব শেষ ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবেলা করলেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।


এখন আবার শোনা যাচ্ছে নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থানের পদধ্বনি!


তুরস্কের ১০৪ জন সাবেক অ্যাডমিরাল এক যৌথ বিবৃতিতে সরকারের একটি খাল খনন প্রকল্প বাতিল এবং ১৯৩৬ সালে স্বাক্ষরিত মন্ট্রেক্স চুক্তি নিয়ে নতুন কোনো আলোচনা না করতে পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে এই দুই বিষয় নিয়ে সামনে আগালে তুরস্ক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে।


এবং এ বিবৃতিটি প্রকাশ হয় শনিবার মধ্যরাতে।


সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস এবং তুরস্কের বিগত  সামরিক অভ্যুত্থানগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, ১০০ উচ্চ পদস্থ সাবেক সামরিক কর্মকর্তার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মধ্যরাতে এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ বিবৃতি বিকল্প পন্থায় সরকার উৎখাতে ইন্ধন যোগাবে।


খাল খনন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?


যে খাল খনন নিয়ে এই বিবৃতিটি আসে সেই "ইস্তান্বুল খাল" প্রথম আলোচনায় আসে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান সুলায়মানের সময়। তার পর ১৫৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ বার ইস্তান্বুলে একটি বিকল্প খাল খননের প্রস্তাব করা হয়। 


সর্বশেষ ২০১১ সালের নির্বাচনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান নতুন করে ইস্তান্বুলের বুক চিরে এই কৃত্রিম জলপথ তৈরির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। নির্বাচনী ইশতেহারে এই খাল কাটার ঘোষণা দেন। 


মারমার সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরকে যুক্তকারী এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় "ক্যানেল ইস্তান্বুল" বা "ইস্তান্বুল খাল"। সুয়েজ খাল এবং পানামা খালের মত বছরের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ উপার্জনের আশা‌ দেখানো হয় এই‌ খালের মাধ্যমে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা থেকেই যায়। 


এই খাল যে দুটি সাগরকে যুক্ত করবে সে দুটি সাগর তো ফসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে আগে থেকেই প্রাকৃতিকভাবে যুক্ত! 


ভূমধ্যসাগর থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার জাহাজ এই ‌বসফরাস প্রণালী দিয়েই‌ কৃষ্ণ সাগরে যায়। এবং বিনা টোলে, অর্থাৎ কোন টাকা-পয়সা খরচ না করে ফ্রি পার হয়‌ এ প্রণালী। 


তাহলে ইস্তান্বুলকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিলিয়ন ডলারের যে স্বপ্ন এরদোয়ান দেখছেন তার কী হবে? 


প্রশ্ন থেকেই যায়!


এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেকেই প্রশ্নটা করে থাকেন। এখানে প্রশ্নটার উত্তর কয়েকভাবে দেওয়া যায়। 


প্রথম হচ্ছে, এই নতুন খাল খনন হলে এটার উপার্জন শুধুমাত্র যে জাহাজ পারাপারের ওপরই নির্ভরশীল হবে বিষয়টি তেমন না। যেমন আমরা জানি বসফরাস প্রণালী দিয়ে পার হওয়া জাহাজ থেকে ঠিকই কোন টাকা আয় করতে পারছে না সরকার; কিন্তু এই প্রণালী তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড,  পর্যটন এবং এই সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত সেক্টর আছে সেগুলো থেকে প্রতিবছর তুরস্কের অর্থনীতিতে যোগ হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। 


ঠিক একইভাবে নতুন খাল খনন হলে এই খনন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে এর তীরবর্তী এলাকায় সরকারের যে বিশাল পরিকল্পনা আছে যেমন ট্যুরিজম, নতুন করে আবাসিক পরিকল্পনা এবং এর সঙ্গে রিলেটেড আরো অনেক প্রকল্প, এগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন হবে। 


আর জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে বর্তমানে বসফরাসের জাহাজ পরিবহন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ তুরস্ক নির্ধারণ করে বসফরাস দিয়ে প্রতিদিন কতটি জাহাজ যাবে কোন সময় জাহাজ যেতে পারবে, কোন সময় পারবে না। এবং বর্তমানে বসফরাস দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সাইজের বড় জাহাজ যেতে পারে না। সুতরাং বড় জাহাজ গুলোর বিকল্প পথ দিয়ে যেতে হবে। আর বর্তমানে একটি জাহাজ বসফরাস পার হওয়ার অনুমতি এবং সিরিয়াল পেতে সময় লাগে এক থেকে তিন দিন। 


তুরস্ক এই জাহাজ চলাচলের উপর আরেকটু বিধি নিষেধ করে অর্থাৎ আরেকটু কম জাহাজ চলাচল করায়, জাহাজগুলোকে যদি আরেকটু ওয়েট করায় তাহলে দেখা যাবে এই জাহাজগুলোর তিন দিনেরও বেশি অপেক্ষা করা লাগতে পারে। একটি মালবাহী জাহাজ একদিন দেরী করা মানে ওখানে বিশাল পরিমাণ একটা ক্ষতির বিষয়। সুতরাং এ জাহাজগুলো তখন ভিন্ন পথ দিয়ে যেতে বাধ্য হবে এবং তারা স্বাভাবিক ভাবে বিকল্প রুট ব্যবহার করবে টাকা দিয়ে হলেও।



তুরস্কে কেন বারবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়?


তুরস্ক, সামরিক অভ্যুত্থান যেন দেশটির পিছু ছাড়ছে না।  


১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভালোই চলছিল প্রথম কয়েক দশক। কিন্তু আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো  নামক সামরিক জোটটির সদস্য হওয়ার পর থেকেই সামরিক অভ্যুত্থানের শুরু। তুরস্কের ন্যাটো সদস্য পদ আর সামরিক অভ্যুত্থান যেন এক সুতোয় গাঁথা।  


তুরস্ক ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে ১৯৫২ সালে। 


দেশটিতে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয় ১৯৬০ সালে। তুরস্কের প্রথম গণতান্ত্রিক নেতা আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে সামরিক জান্তা। একটি টু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি পশ্চিমা জোট। কারণ প্রধানমন্ত্রী মেন্দেরেস তখন রাশিয়ার সঙ্গে তার দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। 


১৯৭১ সালের ১২ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে। তুরস্কে আবার রাস্তায় ট্যাঙ্ক আর সামরিক বুটের শব্দ। নির্বাচিত সরকারকে জোড় করে উৎখাত করলো সামরিক জান্তারা। 


১৯৮২ সালে আবার সামরিক অভ্যুত্থান। ১৯৯৭‌ সালের সংঘঠিত হয় উত্তর আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থান।

২০১৬ সালে নতুন সরকারের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা। 

এছাড়াও ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৯, ১৯৭৯, ২০০৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয়েছিল।


সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনের শক্তি


এখনো পর্যন্ত তুরস্কে যতগুলো সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে সবগুলোরই পিছনে আমেরিকা তথা ন্যাটোর হাত ছিল। আর এগুলো কখনোই পরোক্ষভাবে নয়। একেবারে প্রত্যক্ষভাব। আমেরিকা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়ানোয় ওস্তাদ। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকলে তো কথাই নেই। গণতন্ত্র ছাড়া যেন তাদের টয়লেটই হয় না। 


অথচ সেই গণতন্ত্রের গড ফাদার কিন্তু তুরস্কের কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কখনো কোনো টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বরং সামরিক জান্তকে বাহবা দিয়েছে প্রতিটি অভ্যূত্থানের পরে।


যেমন দেখুন, ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে তুর্কিরা ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে গণতন্ত্রের জন্য। সারা পৃথিবীর যেখানে এই গণতন্ত্রকামী জাতির পাশে দাঁড়ানোর কথা, গণতান্ত্রিক সরকারকে সাপোর্ট দেয়ার কথা, সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টাকে ব্যার্থতায় পর্যবসিত করতে সক্ষম হওয়ায় তুরস্ককে বাহবা দেয়ার কথা সেখানে এই আমেরিকা এবং তার দোসররা উল্টো গণতান্ত্রিক সরকারকেই দোষারোপ করলো!


এবং তখন থেকেই গণতান্ত্রিক সরকারকে অগণাতান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেই যাচ্ছে একেরপর এক। 


এমনকি তারা সরাসরি ঘোষণা দিয়ে নামছে এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে। ছলে বলে, কৌশলে যেকোনো ভাবেই হোক তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হবে। 


কারণ? 


আদনান মেন্দেরেস, তুরগুত ওয়াল, নাজিমউদ্দিন এরবাকান, এরদোয়ানরা যখনই আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন, আমেরিকার আজ্ঞাবহ গোলামীর জিঞ্জির‌ ভেঙে বেড়িয়ে যেতে চেয়েছেন, দেশকে সাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন তখনই সামরিক বাহিনীক লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।কখনো গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে, কখনো মানবাধিকারের মুগুর দেখিয়ে, কখনো সমকামী স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে, কখনো মুক্ত বাণিজ্যের বেড়াজালে আবদ্ধ করে, তুরস্ককে শিকল পরিয়েছে । 


সুতরাং, তুরস্ক যতদিন এই শিকল পুরোপুরি ভেঙ্গে সকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারবে ততদিন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। কখনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, কখনো অর্থনৈতিক হামলার মাধ্যমে আর কখনো বা সন্ত্রাস লেলিয়ে দিয়ে।


লেখক: সরোয়ার আলম, চিফ রিপোর্টার এবং আঞ্চলিক প্রধান, আনাদলু এজেন্সি

মন্তব্যসমূহ