দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে ঢোকা সব ক’টি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় নদী-উপনদীর পানি সোমবারও (১৪ আগস্ট) বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের কুশিয়ারাসহ আরও কিছু নদী ও হাওর এলাকা। ফলে দেশের ১৩টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি এখনও অবনতির দিকে। বন্যায় এ পর্যন্ত ২৪ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন প্রায় ১৭ লাখ পানিবন্দি মানুষ। বন্যাদুর্গত এসব জেলা হচ্ছে, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোনা। তবে নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
আমাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার মধ্যে চারটিই প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সোমবার (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে পাঁচ জন মারা গেছেন। অন্যদিকে, পাঁচটি উপজেলায় ৩৫টি ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার ১ লাখ ২ হাজার ৭৫০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যার ব্যাপারে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তার ব্যারাজের পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে, ধরলায় পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নীলফামারী প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় দফা বন্যায় জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার অন্তত ৩৫ গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য বিশেষ করে শিশু খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, সোমবার (১৪ আগস্ট) সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জেলার সদর, চিরিরবন্দর, বিরল, কাহারোল, বীরগঞ্জ, ঘোড়াঘাট উপজেলা। এসব উপজেলায় বন্যার কবলে পড়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম। দিনাজপুরের প্রধান ৩টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ইছামতি নদীর পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং পূর্ণভবা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে অন্যান্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও পূর্ণভবা নদীর পানি কমছে।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রবিবার (১৩ আগস্ট) উপজেলার ভাঙ্গামোড় ও বড়ভিটা ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। জেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বাঁধ,উঁচু সড়ক,আশ্রয়কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গতরা। এর মধ্যে খাদ্য সংকটে পড়েছেন বানভাসীরা। অনেকের ঘরে খাবার থাকলেও তা রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছেন না তারা। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, চিলমারী পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধরলা নদীর পানি ফেরিঘাট পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কাউনিয়া পয়েন্টে কমতে শুরু করেছে তিস্তার পানি। ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি সামান্য কমে যাওয়ায় ফুলবাড়ী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের ঘর-বাড়ি থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করেছে।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে বন্যা কবলিত হয়ে একজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন আরও একজন। এ জেলায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যাও। রবিবার (১৩ আগস্ট) উপজেলার ৯ ইউনিয়নে ৩০ হাজারও মানুষ পানিবন্দি ছিলেন। সোমবার (১৪ আগস্ট) এ সংখ্যা ৪০ হাজারে পৌঁছেছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন জানান, সোমবার সকাল পর্যন্ত কালিতলা হার্ড পয়েন্ট এলাকায় যমুনা নদীর পানি ২৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ফাঁটল দেখা দেওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও হুমকির মুখে পড়েছে।
নওগাঁ প্রতিনিধির পাঠানো খবরে প্রকাশ, এ জেলার ১১ উপজেলার মধ্যে তিন উপজেলা দ্বিতীয় দফা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। উপজেলাগুলো হলো- আত্রাই, রায়নগর ও মান্দা। এ তিন উপজেলায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত হতাহতের খবর নাই। আত্রাই নদীর পানি মান্দা পয়েন্টে ২০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর ছোট যমুনা নদীর পানি নওগাঁ ব্রিজ পয়েন্টে ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
রাজশাহী প্রতিনিধির খবরে উল্লেখ, টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৫টি প্লাবিত হয়েছে। এতে ১০ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম টিপু জানিয়েছেন, রাজশাহীতে পদ্মা নদীর বিপদসীমা হচ্ছে ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। তবে পানি এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। সোমবার ( ১৪ আগস্ট) সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৬২ মিটার, দুপুরে ছিল ১৬ দশমিক ৬৬ মিটার। তবে যেভাবে পানি বাড়ছে, তাতে করে দু-একদিনের মধ্যে বিপাদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে রবিবার (১৩ আগস্ট) সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৪২ মিটার, দুপুরে ১৬ দশমিক ৪৮ মিটার, সন্ধ্যায় ১৬ দশমিক ৫৭ মিটার এবং শনিবার ( ১২ আগস্ট) সকালে ছিল ১৬ দশমিক ২৪ মিটার, দুপুরে ১৬ দশমিক ২৯ মিটার ও সন্ধ্যায় ছিল ১৬ দশমিক ৩৩ মিটার।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো আব্দুর রহিমের বরাতে সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এ জেলার সদর, কাজীপুর, সাজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার ৪০ ইউনিয়নের ২৪৭টি গ্রামের ৫০ হাজার ১২৫টি পরিবারের দুই লাখ ৩২ হাজার ৫০০ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে ২ হাজার ৪৯৪ হেক্টর, ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১৩টি, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮ হাজার ২৩৪টি। সোমবার সন্ধ্যায় যমুনার পানি ৪৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটি প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের দাবি, পাঁচ উপজেলায় তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে কেউ মারা যাননি। কুশিয়া নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৯.৬ সেন্টিমিটার এবং শ্যাওলা পয়েন্টে ১৪.২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ জেলায় প্রায় ২০ হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে বন্যা কবলিত হয়ে মৃদুল (৪) নামে আব্দুর জব্বার নামের এক ব্যক্তির ছেলে মারা গেছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বৃষ্টিপাতও অব্যাহত রয়েছে।
জামালপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়েছে, এ জেলার পাঁচ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সোমবার সন্ধ্যায় জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিকাল ৩টার দিকে বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, জেলার ছয় উপজেলার সাতশ’ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে হতাহতের কোনও খবর মেলেনি। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, সোমবার দুপুর পর্যন্ত জেলার সবক’টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, এর মধ্যে সুমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার, কংস ১৮২ সেন্টিমিটার, উবধাখালি নদীর পানি ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের দূভোর্গ আরও বাড়বে।
এদিকে, আমাদের শেরপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ পাঁচ জেলার নদ-নদীর পানি কমছে। বাংলা ্ট্রিবিউন
মন্তব্যসমূহ