‘বাবা পড়াশোনা আর রেজাল্টের জন্য তোমাকে অনেক মেরেছি, বকাঝকা করেছি, মাফ করে দিও। দেখা হবে কেয়ামতে, এই বলে ছেলেকে চুমু দেই। সেও আমার গালে চুমু দেয়।’
১৩ বছরের ছেলেকে এ কথা বলে লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন তা মা রিনা বেগম।
অথচ ছেলে ইমরান হোসেন রানা সাঁতার জানত না। মা হয়ে তবুও এমনটি কেন করলেন তিনি!
সেই ব্যাখ্যাও আছে। লঞ্চে তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রাণে বাঁচার আশায় দ্বিগবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন যাত্রীরা।
লঞ্চ থেকে না বের হতে পারলে আগুনেই পুড়ে ছাই হবে ছেলে, তার চেয়ে বরং নদীতে ঝাঁপ দিলে হয়ত বেঁচেও যেতে পারে সে।
বৃহস্পতিবার ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর মাঝখানে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেঁচে ফেরা এক যাত্রী এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা রিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আর শ্বশুরবাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায়। তিন দিনের ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে সেখানেই বেড়াতে যাচ্ছিলাম। সদরঘাটে লঞ্চে (অভিযান-১০) উঠে কেবিন, চেয়ার কিছুই পাইনি। লঞ্চ ছিল যাত্রীতে ঠাসা। নিচতলার ডেকের মাঝামাঝি একটু জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়ি। রাতে ছেলে ঘুমালেও আমি ঘুমাতে পারিনি। হঠাৎ করে যখন ডেকের ভেতরে ধোঁয়া আর আগুন আসতে থাকে। তখন ছেলেকে টেনে অপরদিকে নিয়ে যাই। ততক্ষণে দেখি অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলে তো সাঁতার জানে না, তাই প্রথম ভেবেছি নদীতে ঝাঁপ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর তখন লঞ্চটি মাঝ নদীতে। শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেই। এরপর দেখি ছেলের মাথা ভাসছে। তখন আমিও বোরকা ছিঁড়ে ফেলে নদীতে ঝাঁপ দেই। ছেলেকে ধরে কোনভাবে খুব কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই।’
এভাবেই নিশ্চিত দুয়ার থেকে সন্তানকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেন এক মা।
লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আরো অনেকের। তাদের কেউ কেউ রীনা বেগমের মতো ভাগ্যবতী ছিলেন না। অনেকেই তাদের পরিবার পরিজন হারিয়ে দিশেহারা।
লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীসহ সুগন্ধা তীরের মানুষদের মুখে শোনা গেল এমন অনেক মর্মান্তিক, লোমহর্ষক ঘটনা।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা শুক্রবার দুপুরে লঞ্চে তল্লাশি শেষ করেছেন। তল্লাশি অভিযানের পর পুরো লঞ্চটি ঘুরে লোহার পাত আর যন্ত্রাংশ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। এমনকি লঞ্চের কেবিনের দরজা, আসবাবপত্র সবকিছুই আগুনে পুড়ে গেছে। লোহার ডেকের ওপর শুধু কয়লা-ছাই আর ভাঙ্গা কাঁচের স্তূপ। এমনকি দরজা-জানালার কাঁচ, বাথরুম ও সিঁড়িতে থাকা টাইলসগুলোও ফেটে চুরমার হয়ে গেছে।
হতভাগা যাত্রীদের মতে, আগুন ধরে যাওয়া লঞ্চ নদীতীরে তাৎক্ষণিকভাবে ভিড়লে হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যাওয়ার পর প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট চলার পর আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। আগুনের তীব্র উত্তাপে লঞ্চের স্টিল কাঠামোর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় প্রায় দরজা আটকে যায়। ফলে লঞ্চ থেকে অনেকে বেরুতে পারেননি। নদীতেও অনেকে ঝাঁপ দিতে পারেননি। ফলে বদ্ধ উনুনে পুড়ে মরেছে মানুষ।
যুগান্তর
মন্তব্যসমূহ