পাকিস্তানের পর এবার মিয়ানমার নিয়ে মহাপরিকল্পনায় চীন। আর এতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ভারতের। লগ্নিপুঁজি বিনিয়োগে অন্যেরা যেখানে যেতে রাজি নয়, সেখানেই পা রাখতে প্রবল আগ্রহ চীনের। শুক্রবার দুদিনের সফরে মিয়ানমারে যাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শুধু সড়ক নয়, দ্রুতগামী ট্রেনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ওই বন্দরকে জোড়ার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
সামগ্রিক ভাবে দেখলে মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় বিদেশি লগ্নিকারী হিসেবে চীনের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করাই শি জিনপিং সফরের মূল লক্ষ্য। এবং সেই লক্ষ্যে সু চি-র সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। কথা বলবেন সেনাপ্রধান মিন আউঙ লেইং ও প্রেসিডেন্ট উ উইন মিয়িন্টের সঙ্গে।
এমনিতে মিয়ানমারের সঙ্গে যে চীনের সম্পর্ক মধুর তা নয়। চীনা লগ্নিতে যে ঋণের ফাঁদে দেশ বিকিয়ে যেতে পারে- সেই আশঙ্কা রয়েছে মিয়ানমারেরও। তাদের বিদেশি ঋণ যত, তার ৪০ শতাংশই চীনের কাছে। কিয়াউকফিউ বন্দরের উন্নতি ঘটাতে চীন ৭২০ কোটি ডলার ঢালতে চেয়েছিল। কিন্তু দেনার দায়ে বিকিয়ে যাওয়ার ভয়েই সেটা ১৩০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে সু চি-র দেশ।
এই বিপদের কথা ভালভাবে জানে পাকিস্তানও । তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘মিত্র’ দেশের রক্ষাকারীর ভূমিকা নিয়ে সেই দেশে পরিকাঠামো ও লগ্নি প্রসারের রাস্তা করে নেওয়াটা চীনের পরিচিত কৌশল। পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে লগ্নি করে ও চীন-পাকিস্তান আর্থিক করিডর গড়ে তুলে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত নিজেদের বাণিজ্যপথ অবাধ করতে চায় চীন। এ জন্য সন্ত্রাসে মদদের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোণঠাসা পাকিস্তানের ঢাল হতেও দ্বিধা নেই বেইজিংয়ের। বার বার সেটার প্রমাণ পেয়েছে ভারত।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও চীনের কৌশল একই। রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা পাশে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনাতেও প্রভাব খাটাচ্ছে বেইজিং। লক্ষ্য, মিয়ানমারে সড়ক ও রেলপথ গড়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বাণিজ্যপথের বিস্তার ঘটানো। বিশ্বের বিশাল অংশ জুড়ে চীনের সামরিক দাপটও বাড়বে যার মাধ্যমে।
পাকিস্তানের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক থাকলেও চীন-পাকিস্তান আর্থিক করিডরের পথে বড় বাধা ভারত। কারণ, ওই সড়কের অনেকটা হওয়ার কথা পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে, ভারত যা নিজেদের বলে দাবি করে। ফলে ওই সড়ক নিয়ে গোড়া থেকেই জোরালো আপত্তি জানিয়ে যাচ্ছে ভারত।
প্রসঙ্গত, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে পরাশক্তিগুলোর নৌআধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মিয়ানমার এমনকি বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ব্যবহৃত হওয়ার মতো ক্ষেত্রও প্রায় প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি ও কৌশলগত শক্তি ভারসাম্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় কার কার কী অবস্থান ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পৃক্ত তা বাংলাদেশেরও আশু মনোযোগের দাবিদার।
চীন মিয়ানমারের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে সহায়তা প্রদান করে তার মধ্যে “আইয়াওদ্দা সড়ক প্রকল্প’’(Ayeyawaddy Transportation Project) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ইউনান থেকে মায়ানমারের ইয়াংগুনের থিলওয়া বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনই এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর অধীনে ভামো পর্যন্ত নদীপথের ড্রেজিং করা, ভামোতে একটি কন্টেইনার পোর্ট নির্মাণ করা এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত বন্দর মুজে বা লিউজেল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মূল উদ্যেশ্য হচ্ছে মিয়ানমারের মধ্যদিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে চীনাদের বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় অনেক বেঁচে যাবে, এবং মালাক্কা প্রণালীর সংঘাত এড়িয়ে চলা যাবে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও সহজেই প্রবেশ করা যাবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সমুদ্র সীমা নিয়ে সমস্যার ক্ষেত্রেও চীনের এই প্রকল্পটির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশেও একটি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে চীন ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এছাড়া সেখানে একটি শিল্প পার্ক এবং একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলারও পরিকল্পনা আছে চীনের। ফলে রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবিক ইস্যুর চেয়েও এই বিনিয়োগকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।
এই দিকগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বিশ্বরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং সামরিক ও কৌশলগত অবস্থানের চাপে শক্তিভারসাম্যেও যে সমীকরণ তৈরি হচ্ছে তাতে মিয়ানমার বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে। চীন-পাকিস্তান জোট ও ভারত-মার্কিন জোটের আবির্ভাবের ফলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। বাংলাদেশের জন্য যা নানা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
মন্তব্যসমূহ