বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ করলেও সেটি সরকারের কাছে তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছেনা । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে রামপালেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে।
কিন্তু বামপন্থী সংগঠনগুলোর আন্দোলনে কোন ভাটা পড়েনি। বৃহস্পতিবার খুলনা শহরে তারা রামপাল প্রকল্প বিরোধী সমাবেশের পাশাপাশি আরো কিছু কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।
বামপন্থী সংগঠনগুলোর আন্দোলনে সাধারণ মানুষের খুব একটা অংশগ্রহণ না থাকলেও সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই এ প্রকল্পের বিপক্ষে কথা বলছেন। ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন সংস্থা এ প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের জ্বালানী বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদদের অনেকেই মনে করেন, সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করলেই ভালো হতো।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও সরকার কেন এ প্রকল্প নিয়ে অনড় -- সেটি নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং অনুমান আছে।
সরকার বিরোধীদের অনেকেই মনে করেন, এ প্রকল্পের সাথে ভারত সম্পৃক্ত থাকায় বাংলাদেশ সরকার এখান থেকে পিছিয়ে আসতে চাইছে না ।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জ্বালানী বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন জানালেন, রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে ভারতের আগ্রহের পাশাপাশি বাংলাদেশের চাহিদা ছিল।
"বাংলাদেশ চাচ্ছিল যে তাদের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কোস্টাল এরিয়ার (উপকূলীয় এলাকার) বিভিন্ন জায়গায় হবে। কারণ বিদ্যুতের জন্য কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়," বলছিলেন অধ্যাপক হোসেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দেশের একটি অঞ্চলে বেশি না করে বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা হলে বিদ্যুৎ বিতরণে সুবিধা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রামপালের যে জায়গাটিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে সেটি সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দুরে। আন্দোলনকারীরা যুক্তি দিচ্ছেন, এখানে কয়লা পরিবহন করতে হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। ফলে জীব-বৈচিত্র্য বাধাগ্রস্ত হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দূষণ নির্গমন সুন্দরবনকে সংকটাপন্ন করবে।
যে জায়গাটিতে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে যাচ্ছে সেটি ছাড়া ভিন্ন কোন জায়গা কি বাছাই করা যেত?
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন মনে করেন, একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেই যে পুরো সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে - এমন ধারনার সাথে তিনি একমত নন। তবে জীব-বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করে অন্য আরেকটি জায়গায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরিয়ে নেয়া যেত।
অধ্যাপক হোসেন জানালেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছিল সেটি উপস্থাপনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দু'টো জায়গার কথা বলা হয়েছিল। এখন যে জায়গাটিতে নির্মিত হতে যাচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরেকটি জায়গার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান জায়গাটিতে জমির মূল্য কম হওয়ার কারণে এ জায়গাটি বাছাই করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে রামপাল প্রকল্পের জন্য যে পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছে সেটি 'বিশ্বমানের' হয়নি বলে মনে তিনি।
"এইআইএ রিপোর্টটা তো সরকার করিয়েছে। মোটামুটি সরকার যেভাবে চিন্তা করেছে তারা ওভাবেই ওটা পরিবেশন করেছে। আমি সরকারকে বলেছিলাম একটা আন্তর্জাতিক থার্ড পার্টি দিয়ে এটা করালে আপনাদের জন্যই ভালো হতো। তাহলে আর কোন বিতর্ক থাকতো না," বলছিলেন অধ্যাপক হোসেন।
রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সকল প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ অনুমোদনও হয়েছে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছে। সরকার মনে করে এমন অবস্থায় এ প্রকল্প থেকে পিছ পা হবার কোন সুযোগ নেই। সরকারের দাবী পরিবেশগত সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই।
জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, সুন্দরবনের ক্ষতি না হবার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই এ প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের কথা চিন্তা করেই এ রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মি: হামিদ বলেন, "আমাদের বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের দুই থেকে তিন শতাংশ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ব্যবহার করে। যেদিন পদ্মা সেতু হবে এটা সাত শতাংশের উপরে চলে যাবে। তখন সে এলাকায় মিনিমাম (কমপক্ষে) তিন হাজার মেগাওয়াট জেনারেশন (উৎপাদন) হতে হবে। আমাকে বিদ্যুৎ দিতে হবে। টার্গেটটা ওখানে।"
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সে এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা পরিবহন সহজ হবে। তিনি মনে করেন, সুন্দরবন থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে।
সরকার এও মনে করছে যে আন্দোলন যারা করছে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। সূত্র: বিবিসি
মন্তব্যসমূহ