হিজবুল্লাহর ভয়াবহ রকেট হামলা, প্রতিরোধে ব্যর্থ ইসরাইল

লেবানন থেকে ফিলিস্তিনির হাইফা এবং গালিলি অঞ্চলের দিকে অন্তত ৩৫টি রকেট ছোঁড়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। সেনা সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ লেবানন থেকে এই রকেট হামলা চালানো হয়, এবং এসব রকেট হাইফা এবং পশ্চিম গালিলির দখলকৃত অঞ্চলে আঘাত হানে। জায়নিস্ট গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনো রকেট বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়নি। হাইফা শহরের বিভিন্ন এলাকায় রকেট হামলার সতর্কবার্তা শোনার খবর পাওয়া গেছে। আল-মায়াদিন টিভি চ্যানেল জানায়, হাইফার উত্তরে আল-কিরিওত এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। জায়নিস্ট গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দখলকৃত পশ্চিম গালিলির ইয়ারা শহরে এক ভবন হিজবুল্লাহর মিসাইল হামলায় পুড়ে যায়। অপরদিকে, আভিভিম, ইয়রাউনসহ ওপরের গালিলির বেশ কয়েকটি শহরে রকেট হামলার সতর্কবার্তা বাজানো হয়। সূত্র: মেহের নিউজ

‘ভারতে এতটা কোণঠাসা কখনোই ছিল না মুসলমানরা’

 



প্রায় তিন দশক সময়, ৮৫০ জন সাক্ষী, স্থিরচিত্র, ভিডিওসহ ৭ হাজার প্রমাণাদি থাকার পরও পবিত্র শহর অযোধ্যায় হিন্দু উগ্রবাদীদের হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ১৬ শতকের ঐতিহ্যবাদী বাবরি মসজিদ মালায় একজনকেও দোষী সাব্যস্ত করেনি ভারতীয় আদালত।


জীবিত ৩২ অভিযুক্তদের মধ্যে ভারতের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা কৃষ্ণ আদভানি রয়েছেন। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) তিনিসহ অভিযুক্ত সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।


আদালতের ভাষ্য, ১৯৯২ সালে সমাজবিরোধী নামপরিচয়হীন দুষ্কৃতিকারীরা মসজিদ ধ্বংস করেছে এবং তাতে পূর্বের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আদালতের পর্যবেক্ষণ দাঁড়ায়, দুর্ঘটনাবশত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে।


কয়েক ঘণ্টায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। তার আগে প্রকাশ্যে মহড়ায় অংশ নেয় উগ্রবাদীরা। সেখানে  স্থানীয় পুলিশের অনেক সদস্য উপস্থিত ছিল। হাজার হাজার মানুষ মসজিদ ভাঙার সে দৃশ্য দেখেছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যও নিয়েছিল তদন্ত কমিশন। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) বিচারিক আদালত সবকিছুকে অস্বীকার করেছে।



গেলো বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করে বাবরি মসজিদ ভাঙা একটি পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড। যা আইনের শাসনের ভয়াবহ লঙ্ঘন।


তাহলে খালাসকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?


সাধারণভাবে রায়কে ভারতের বিচার ব্যবস্থার নিস্ক্রিয়তা এবং বিশৃঙ্খলার আরেকটি কলঙ্কজনক উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। অনেকের শঙ্কা এ রায় কয়েক দশকের রাজনৈতিক সাহসী পদক্ষেপের ফলে যে ভিত গড়ে উঠেছিল তাকে ধ্বংস করে দেবে। দুর্বল করে দেবে রাজনৈতিক সক্ষমতাকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে যেভাবে কোনঠাসা করা হচ্ছে-প্রান্তিকরণ করা হচ্ছে সে প্রক্রিয়াকে এ রায়, আরো ত্বরান্বিত করবে।

আরও পড়ুন: রাহুল গান্ধীকে 'পেটানোর' পর গ্রেফতার করলো পুলিশ

নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার মুসলমানদের একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারত নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাবি কর আসছে। ভারতের বহুত্ববাদী এবং অসাম্প্রদায়িকতা চর্চার ইতিহাসে কোনো শাসনামলেই মুসলমানরা এতটা কোণঠাসা হয়নি।


গরুর গোস্ত খাওয়া এবং গরু বহনকারীদের ওপর হিন্দু উগ্রবাদীরা হামলা চালিয়েছে। গরু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুতে কাছে পবিত্র জিনিস বলে বিবেচিত। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া অমুসলমি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য আইন সংশোধন করেছে। মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু এবং কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছে মোদি সরকার। বাতিল করা হয়েছে রাজ্যের সাংবিধানিক স্বায়ত্বশাসনের অধিকার। রাজ্যটিকে ভেঙে কেন্দ্রে শাসিত আলাদা দুটি অঞ্চলে ভাগ করেছে বর্তমান ভারত সরকার। 


চলতি বছরের শুরুর দিকে দিল্লিতে মুসলমানদের একটি দলের ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠান থেকে ভারতে করোনা ছড়িয়েছে বলে মুসলমানদের দায়ী করে ভারত। করোনা মহামারির মধ্যে ভারতে হিন্দুদের বিশাল বিশাল সমাবেশ হলেও সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা, সাধারণ মানুষ কিংবা গণমাধ্যম কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, নিন্দা জানায়নি, এড়িয়ে গেছে।


শুধু তাই নয়, গেলো শীতে দিল্লিতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে দাঙ্গা উস্কে দেয়ার অভিযোগে মুসলিম শিক্ষার্থী এবং সমাজকর্মীদের আটক করে জেলখানায় পুরে প্রশাসন। অথচ দাঙ্গা উস্কে দেয়ায় অভিযুক্ত বহু হিন্দুকে মুক্তি দেয়া হয়। বাবরির রায়কে অনেক মুসলমান মনে করছেন, তাদের ওপর চালানো ধারাবাহিক নিগৃহ, অপমান, অপদস্থের অংশ।


ভারতের মুসলমানদের অব্যাহতভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে দেশটির প্রধান আদর্শ হিন্দুত্ববাদকে ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারণ করছে মোদি প্রশাসন। দেশটির জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলো সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে; তাদের মন্দ বলছে। এক সময় আঞ্চলিক শক্তিশালী অনেক দল মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে থাকলেও, এখন তারা সরে গেছে। প্রধানবিরোধী দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করলেও বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। দেশটিতে মুসলমান পক্ষে কথা বলার মতো নেতার সংখ্যাও খুব কম। 


'রাষ্ট্র পরিচালনার পুরো পদ্ধতির ওপর থেকে মুসলমানদের আস্থা উঠে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম তাদের দোষত্রুটি খুঁজছে। নিজেদের পরিত্যক্ত মনে করছেন মুসলমানরা। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক হতাশা রয়েছে। বলেন, দিল্লি ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সহযোগী গবেষক আসিম আলী। 


সত্য হচ্ছে ভারতের প্রান্তিক মুসলমানদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুসলমানরা একইসেঙ্গ দেশবিরোধী এবং দেশপ্রেমিক। সমস্যা হচ্ছে যাদের দেশপ্রেমিক বলা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদীরা। ভারতের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে মুসলমানদের খুব একটা ফায়দা কখনোই হয়নি।' বলেন আসিম আলী।


এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের শহরতলীগুলোতে মুসলমানরা সংকুচিত পরিসরে বসবাস করছে। দেশটির কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা পর্যায়ে মুসলামনদের অংশ গ্রহণ ৩ শতাংশেরও কম। যদিও দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলমান। 


প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা অনেক হলেও মাধ্যমিকে গিয়ে অধিকাংশ মুসলিম শিক্ষার্থী ঝরে পরে। কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। ভারতের পার্লামেন্টে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব অব্যাহতভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে। ১৯৮০ সালে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৯ শতাংশ মুসলিম প্রতিনিধি থাকলেও বর্তমানে ৫ শতাংশেরও কম। ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাদের দল থেকে নির্বাচিত কোনো মুসলমান জনপ্রতিনিধি ছিল না। যা দেশটির ইতিহাসে প্রথমবার।


নরেন্দ্র মোদি এবং তার সহকর্মীরা বরাবরই বলে আসছেন, তাদের দল কোন ধর্মের বিরুদ্ধে বৈষম্য করে না। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাকে অনেক মুসলিম দেশ সমর্থন করে। তার সরকারের কল্যাণমুখী নানা সুবিধা ধর্ম-বর্ণ নির্বিষে প্রত্যেক দরিদ্র ভারতীয়র কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বলে দাবি তার। কয়েক বছর ধরে বিজেপি, উদারপন্থী বিরোধী দলগুলোকে ভণ্ড ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে।


কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এই অভিযোগের সত্যতা আছে। উদাহরণ হিসেবে তারা কমিউনিস্টদের দিকে ইঙ্গিত করেন। যারা তিন দশকেরও বেশি সময় পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাসন করেছিল। ব্যাপকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা তারা করতো। মুসলমানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমান।


ব্যতিক্রমও আছে। ধর্মীয় উত্তেজনা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য কুখ্যাত ভারতের গুজরাট। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে সেখানকার মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার রক্ষার সূচকে এগিয়ে গুজরাট। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মির্জা আসমার বেগ বলেন, ভারতে বাজার ব্যবস্থাপনা ধর্মভিত্তিক নয়। তাই গুজরাটেরর মতো রাজ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই ব্যবসায় উন্নতি করছে।


তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিজেপি’র ধর্মীয় নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুশীলন মুসলমানদের অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘আপনি কীভাবে মেরুকরণ করবেন? অন্যকে আপনার পরিচয়ের জন্য হুমকি তৈরি করে।' বলেন, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফ জাফ্রেলোট। তিনি বিশ্বাস করেন, ভারত জাতিগত গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিগত গণতন্ত্র, জাতিগত জাতীয়করণের ফলে তৈরি। যা স্বকীয়তা এবং শ্রেষ্ঠত্বকে ধারণ করে।'


আলী বলেন, এখনো সব অন্ধকারে ডুবে যায়নি। ৪৭ এর দেশভাগের ভূত থেকে বেরিয়ে অনেক অল্প বয়স্ক মধ্যবিত্ত তরুণের উত্থান হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। অনেক মুসলমান নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমেছে। নির্বোধ সংখ্যালঘুদের ঘুম ভাঙিয়েছে। তারা নিজেদের শিক্ষিত করছে। প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, অনেক তরুণ পোষাকে ইতিবাচক উপায়ে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করছেন। মতামত জানাতে ভয় পায় না তারা।


তবে, শেষ পর্যন্ত খালাস প্রাপ্তরা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে কেবল উদ্বেগ এবং অবিচারের বোধকে আরও গভীর করবে। বলছিলেন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জহির আলী। তিনি বলেন, অনেক উপায়ে মুসলমানরা ভারতে পরিত্যক্ত সম্প্রদায়। তারা নিজেদের ক্ষমতাহীনভাবে। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সব দলের নেতারাই তাদের শোষণ করেছে। দরিদ্রতা সেই পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করছে।


সূত্র: বিবিসি।

মন্তব্যসমূহ