আমেরিকার টেনেসির মাঝারি সাইজের কলেজ শহর মারফ্রেসবু। ইসলামি আইন নিষিদ্ধ করার প্রথম একটি ডানপন্থী প্রচেষ্টা চালানো হয় এখানে। তবে মুসলিম ‘উদ্বাস্তুদের’ রক্ষা পরিকল্পনায় এখানে একজন কংগ্রেসম্যান রয়েছেন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা এখানকার একমাত্র মসজিদটির নির্মাণ কাজ বন্ধের আবেদন জানিয়েছিলেন। যেটি সুপ্রিমকোর্টের রায়ে এ যুদ্ধের অবসান হয়।
শহরের মুসলমানরা এর মধ্যে দিয়েই তাদের জীবন অতিবাহিত করছেন। তারা তাদের সন্তানদের লালন করছে, তাদের নামাজের কথা বলছে, কলেজে অধ্যাপনা করছে, জনগণকে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে। এভাবেই তারা শহরে নাগরিক জীবনে অবদান রাখছেন।
গত বছর যখন প্রতিহিংসামূলকভাবে ‘চাতানোগায়’ মাত্র ৯০ মিনিটের ব্যবধানে একজন মুসলিম কর্তৃক চারজন মেরিন সেনাকে হত্যা করা হয়; তখন অন্যদের মতো তারা সমান শোক পালন ও নিন্দা জানান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যিনি বারবার মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইকেল ফ্লিনকে তিনি তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নির্বাচিত করেছেন। অতীতে ফ্লিন ইসলাম ধর্মকে একটি ‘ক্যান্সার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখানকার প্রায় ১৫০০ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আবারো এক গভীর অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে।
সেখানে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে মুসলিদের নানাভাবে হয়রানি ও অপমানের ঘটনা ঘটেছে। বিদ্যালয়, পার্কিং লট, প্রকাশ্যে রাস্তায় এসব ঘটনা ঘটলেও পুলিশ তেমন কোনো কিছুই করতে পারেনি।
মধ্য টেনেসির স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রকৌশলীর একজন অধ্যাপক এবং ‘মারফ্রেসবুর’ ইসলামি সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সালেহ বেনাতি বলেন, ‘এখন আমরা আশা করছি যে, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে। তবে, এই অশান্ত অবস্থা ঝড়ের আগে না পরে শান্ত হবে তা আমরা বলতে পারছি না।’
টেনেসি অঙ্গরাজ্যের রাদারফোর্ড কাউন্টির ‘মারফ্রেসবু’ আমেরিকার দ্রুত বর্ধমান শহরগুলোর অন্যতম এবং ক্রমবর্ধমান বৈচিত্রপূর্ণ একটি শহর। মুসলিম ও খ্রিস্টান ছাত্ররা এখানে একসঙ্গে স্কুলে যায় এবং একসঙ্গে খেলাধুলা করে। তাদের পরিবারের সদস্যরাও একই রেস্টুরেন্ট এবং দোকান গিয়ে কেনাকাটা করে।
অধিবাসীরা বিভিন্নভাবে শহরটির বর্ণনা করে থাকেন। ‘দক্ষিনের আতিথেয়তা’, ‘শহরতলীর নীল বিন্দু’, ‘বাইবেলের বেল্টের ফিতা’ ইত্যাদি।
শহরের দম্পতিদের ধর্মাচরণের জন্য শতাধিক স্থানে উপাসনালয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি আরবি ব্যাপটিস্ট চার্চ ও গ্রেস ব্যাপটিস্টসহ ৫৯টি ব্যাপটিস্ট গীর্জা রয়েছে। এসব চার্চের পুরোহিতরা ২০১০ সালে চার্চের পাশেই ২৩টি বিশাল ‘সাদা ক্রস’ স্থাপনের মাধ্যমে নতুন মসজিদ নির্মাণকে স্বাগত জানান।
ক্যটি'র স্ত্রী হিবা ক্যটির সঙ্গে অন্যরা
তাদেরই একজন আব্দুল ক্যটি। যিনি মসজিদটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়ালগ্রিন্সের একজন ফার্মাসিস্ট এবং জেসন বেনেট যিনি খ্রিস্টান গৃহহীনদের পক্ষে কাজ করে থাকেন। জেসন বেনেট একসময় মসজিদটির নির্মানের অন্যতম বিরোধী ছিলেন। তারা দু’জন এখন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তিনি তার হেলথ সেক্টরে কিছু সংখ্যক মুসলমানদের নিয়োগ দিয়েছেন এবং তিনি যা মনে করেন তা তাদের জানাতে চান না। তবে তিনি এখনো তাদের সঙ্গে রেস্টোরেন্টে খাওয়া ও মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করেন বলে জানান।
অপরপক্ষে, ব্যাপটিস্ট চার্চের একজন যাজক জেমস ম্যকক্যারল জুনিয়র বলেন, ‘আমরা এখন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখতে পাচ্ছি। এখাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অনেকেই মুসলিমদের সম্পর্কে উৎসাহিত হচ্ছে।
আহমেদ রাগিবের পরিবারে সদস্য সংখ্যা তিন জন। তারা হচ্ছেন রক্ষণশীল মুসলমান। অন্যদিকে, ট্যামির পরিাবরেও সদস্য তিনজন এবং তারা রক্ষণশীল খ্রিস্টান। এই দুই পরিবার একই বাড়িতে শেয়ার করে থাকেন। পাঁচ বছর আগে এই দুই দম্পতি মিলে বাড়িটি কিনেন।
আব্দুল ক্যটি
রাগিবের কাছে ট্রাম্পকে একজন হুমকিদাতা বলে মূর্ত হয়। তারা তাকে (ট্রাম্প) এমন একজন লোক হিসেবে জানেন; যিনি মুসলিমদেরকে গালি দেয়া থেকে শুরু করে তাদের সম্পর্কে আক্রমনাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচনের পরের সপ্তাহে তাদের ১২ বছর বয়সী এক মেয়েকে স্কুলে হুমকিও দেয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, ট্যামির বাবা এবং বোন ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। পাঁচ বছরের বিচ্যুত মতামত ও জীবনযাত্রায় এই দম্পতিরা আলাদাভাবে রান্না-বান্না, ভিন্ন চ্যানেলে সংবাদ দেখা এবং বিভিন্ন উৎসব উদযাপন করেন। এরপরেও তাদের মধ্যে একটি সহজ সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। তারা জানান, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তারা একে অপরকে ভালবাসেন।
আহমেদ রাগিব একজন মিসরীয় অভিবাসী। আহমেদ রাগিবের সঙ্গে সাক্ষাতের কয়েক বছর আগে ট্যামি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
ট্যামির বাবা শূকরের মাংস খান, গির্জায় যান এবং তাদের ঘরের পুরোটাই যীশুর মূর্তি দিয়ে সাজানো। তবে তিনি তার নাতনীকে দিনে পাঁচবার নামাজের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তার হিজাবের সঙ্গে মিল রেখে জামাকাপড় বাছাই করতে সাহায্য করে।
ফার্মাসিস্ট ক্যটি কয়েক বছর আগের একটি দিনের কথা স্মরণ করেন। যখন একজন কাস্টমার তার কাছে একটি প্রেসক্রিপশন পূরণ করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, ‘তুমি কি শুনেছ ‘অভিশপ্ত’ মুসলমানরা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চান?’
ক্যটি সিরিয়া থেকে আমেরিকায় অভিবাসী হয়েছেন। তিনি ওই কাস্টমারকে তখন বলেছিলেন, তিনিও একজন মুসলমান।
একথা শুনে শহরের অনেক আরব অভিবাসীদের মত তার চামড়া অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এই বাক্য বিনিময় মুহূর্তের মধ্যে এক দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং এক সপ্তাহ পরে এই আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়।
পরবর্তীতে ওই কাস্টমার এসে ক্যটিকে বলেন, ‘আমি বুঝতে পারিনি আপনি তাদের (মুসলমানদের) একজন। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
ক্যটি বলেন, এই ঘটনা তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই। হয়তো মানুষ একে অপরের সম্পর্কে যথেষ্ট জানে না বলেই এমনটি ঘটে তাকে।
গত বছর ক্যটি মারফ্রেসবুতে মুসলিম যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর উদ্দেশ্য যারা মসজিদ পরিদর্শনে যেতে ভয় পান তাদের কাছে মুসলমানদের দৃশ্যমান করা।
ক্যটি বলেন, ‘ মুসলমানদের সম্পর্কে আমেরিকার মানুষদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই যখন তারা ভয় পায়, তখন তারা প্রতিক্রিয়া দেখান এবং আমি মনে করি, যা করা প্রয়োজন ছিল কিন্তু করা হয়েছে তার বিপরীত। মিত্রতার জন আপনাকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’
নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর মুসলিমরা টাউন স্কোয়ারে জড়ো হন এবং অপরিচিতদের হাতে ফুল তুলে দেন। অন্যান্য ধর্মের কিছু মানুষও এতে যোগ দেন।
পাঁচ বছরের আগে বাসান্ট সালেমের (১৮) বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের একজন অধ্যাপক হয়ে মারফ্রেসবু শহরে আসেন। বাবার সঙ্গে তিনিও এখানে স্থায়ী হন।
তিনি বলেন, ‘এ বছরের গোড়ার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররা আমাদের মুসলিম গ্রুপটিকে দেখার পর অধিকাংশ মানুষ আমাদের কাছে আসে এবং তারা আগে কখনো মুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি বলে তারা জানান।’
সালেমের বোন সামার (২১) বলেন, ‘আমরা তাদের দৃষ্টভঙ্গিতে তেমন পরিবর্তন আনতে চাচ্ছি না। শুধু তাদের সচেতন করছি যে, তারা আমাদের নিয়ে যা ভাবছে আমরা তেমনটি নই।’
বেনেট ‘মারফ্রেসবু কোল্ড প্যাট্রোল হোমলেস’এইড গ্রুপের পরিচালক ও মসজিদের বিপরীতে অবস্থিত একটি গির্জার যাজক। ক্যটির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বেনেট তার চিন্তা চেতনার পরিবর্তন আনেন।
মসজিদটিকে প্রতিবাদকারীরা এবং রাজনীতিবিদেরা সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে থাকে। তিনবার এর বিল্ডিংয়ের পাশের দেয়ালে ধ্বংসাত্মক কার্য চালানো হয় এবং এক পর্যায়ে সরঞ্জামাদির ওপর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে/ আরটিএনএন
মন্তব্যসমূহ